দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে প্রায় সব দলই। এ নিয়ে আলোচনা ও চিন্তাও আছে। কিন্তু ঐক্যের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন ধর্মীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু সামনে এলেই ঐক্যের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
সম্প্রতি কাশ্মির ইস্যুতে প্রথমে কয়েকটি দল পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করা পর ‘কাশ্মির সংহতি ফোরাম’ এর ব্যানারে কয়েকটি ইসলামপন্থী দল একযোগে কর্মসূচি পালন করেছে। এখনো ঘরোয়া বৈঠক করছে। এই সংহতি পরিষদসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের অনেকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থাকে অস্বাভাবিক মনে করে। এই পরিস্থিতি থেকে দেশ ও জাতিকে বের করে আনার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তারা। তবে ঐক্যের লক্ষ্যে কোনো আলোচনা বা উদ্যোগ নেই বলেও তারা জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অরাজনৈতিক সংগঠন হেজাজতে ইসলামের ব্যানারে ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালে প্রায় সব কটি ইসলামপন্থী দল ও আলেম-ওলামাদের যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল সেটাই স্মরণকালের মধ্যে ইসলামপন্থীদের সবচেয়ে বড় ঐক্য ছিল। কিন্তু সেই ঐক্য ওই বছরের ৫ ও ৬ মে এর হেফাজতের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর আর স্থায়ী হয়নি। এ বিষয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে আলেমদের মধ্যে। অনেকের মতে, সরকারি কৌশলেই হেফাজত দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটি অংশ সরকারি সুবিধা গ্রহণের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
আবার আরেকটি অংশ নানা চাপে পড়ে হেফাজতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। যদিও হেফাজতের ১৩ দফার প্রায় সবই ধর্ম সম্পর্কিত ছিল। ইসলামপন্থী দলগুলোর অনেকে হেফাজতে ইসলাম থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। আবার যারা হেফাজতে ইসলামের সাথে রয়েছেন তারাও দু’টি ধারায় বিভক্ত। একটি ২০ দলীয় জোট তথা সরকারবিরোধী জোটের সাথে সম্পর্কিত এবং অপর ধারাটি সরকারি দলের সাথে ঘনিষ্ঠ। সম্প্রতি সরকারি দলের সাথে ঘনিষ্ঠ এমন অংশটির আলেমদের বেশ কয়েকজন সরকারি খরচে ওলামা দলের প্রতিনিধি হিসেবে হজ পালন করে এসেছেন।
হেফাজতে ইসলাম নিজস্ব ব্যানারে বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য বিবৃতি এবং চট্টগ্রাম ও ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু সমাবেশ মিছিলের কর্মসূচি পালন করলেও আগের মতো বড় ধরনের কোনো কর্মসূচিতে আর যায়নি। গতকালও হেফাজতের উদ্যোগে চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি শহরে কাশ্মির ইস্যুতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে। তবে ঢাকায় এখনো কিছু হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিগত নির্বাচনের সময় ইসলামী দলগুলোর একটি অংশকে বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাথে নির্বাচনী এক্য করার জন্য বৈঠক করতে দেখা যায়। ওই দলে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ঐক্যও হয়নি। জাতীয় পার্টি আগের ধারাবাহিকতায় ১৪ দলীয় জোটের সাথেই ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে এবং নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে বর্তমানে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে। তখন আরো দুই-একটি ইসলামপন্থী দলও আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনী ঐক্য করে দুই-একটি আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনাগ্রহের কারণে সেটি শেষ পর্যন্ত হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, ইসলামী দলগুলের কোনো কোনোটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পর্যন্ত সন্দেহভাজন লোক রয়েছেন যারা রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ কোনো কিছু করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। তিনি বলেন, এ দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকলে হয়তো এটা হতে পারত না। এখন অনেকের মধ্যে ভয়ভীতি ও চাপ কাজ করে।
ইসলামী দলগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ অনেকের মতে, ইসলামপন্থীদের মধ্যে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বশূন্যতার কারণেই মূলত ঐক্যের চিন্তা কার্যে রূপ নিতে পারে না। এ ছাড়া দলগুলোর মধ্যে বিভক্তিও অনৈক্যের অন্যতম কারণ। যেমন লালবাগ মাদরাসাকেন্দ্রিক ইসলামী ঐক্যজোট ২০ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর নেজামে ইসলাম পার্টির আরেকটি অংশসহ কয়েকটি অংশ নিয়ে আলাদা ইসলামী ঐক্যজোট গঠিত হয়ে তারা ২০ দলীয় জোটের সাথে সক্রিয় আছে। আবার জমিয়তে উলামায়ে ইসলামীর মুফতি ওয়াক্কাস আলাদাভাবে জমিয়তের নামে ২০ দলীয় জোটের সাথে রয়েছেন। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর নেতৃত্বে মূল জমিয়তও ২০ দলীয় জোটের শরীক হিসেবে রয়েছে। এ দিকে খেলাফত মজলিস অনেক আগ থকেই বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও খেলাফত মজলিস নামে আলাদা দল। খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মওলানা জাফরুল্লাহ খান খেলাফত আন্দোলন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর একই নামে দল ঘোষণা দিয়ে মাঝে মাঝে দুই-একটি কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
জানতে চাইলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব এবং হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী এই প্রতিবেদককে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমরা দলীয়ভাবে কর্মসূচি পালন করছি। আমরা মাঠে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছি। আমরা কাশ্মির সংহতি ফোরামের ব্যানারে কিছুটা বড় পরিসরেও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছি। তিনি বলেন, দেশের যে অবস্থা তাতে এই অবস্থার উত্তরণের জন্য ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবসময় উপলব্ধি করি। ঐক্যের শক্তি ছাড়া এই অবস্থায় পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে ঐক্য নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনার কোনো উদ্যোগ না থাকলেও কিভাবে কী করা যায় তার জন্য রোডম্যাপ তৈরির চিন্তাভাবনা আছে।
প্রায়ই একই ধরনের মনোভাবের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব শায়খুল হাদিসের ছেলে মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি বলেন, ইসলামী শক্তির ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এককভাবে কোনো দলের পক্ষে বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুই করা সম্ভব নয়। যদিও আমরা দলীয়ভাবে কাশ্মির ইস্যুসহ হালের বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ঐক্য নিয়ে আলোচনা নেই, এটা সত্য। তবে চিন্তাভাবনা এবং ঘরোয়া আলোচনায় ঐক্যের বিষয়টি সব সময়ই উঠে আসে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, দেশে বর্তমানে একটি ভীতিকর অবস্থা চলছে। একক দলীয়ভাবে এই অবস্থায় কিছু করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে কিছু করতে হবে। ঐক্যের শক্তিকে সবাই ভয় পায়। ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামী দলগুলো কিছু করলে অবশ্যই ফলাফল পাওয়া যাবে।
খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ঐক্যের প্রয়োজন সবাই অনুভব করেন। কিন্তু ঐক্যের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। এটাই বড় সমস্যা। তিনি বলেন, ইস্যুভিত্তিক মাঝে মধ্যে ছোটখাটো ঐক্য হচ্ছে। কিন্তু বড় ঐক্যের উদ্যোগ নেই।
গত সপ্তাহে এক আলোচনায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস বলেন, মুসলিম উম্মাহর সঙ্কট উত্তরণ বৃহত্তর ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।দেখুন:
Leave a Reply